২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অনূর্ধ্ব-১৯ মহিলা সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপ অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ এশিয়া ফুটবল ফেডারেশন বা সাফ এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ-১৯ ফুটবল প্রতিযোগীতায় এর সাতটি সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশ, ভুটাল, ভারত, মালদ্বীপ,নেপাল,পাকিস্তান ও শ্রীলংকা অংশ গ্রহণ করে থাকে-যে টুর্নামেন্ট প্রতি দুবছর পর পর অনুষ্ঠিত হয়।
৮ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ভারত বনাম বাংলাদেশ। যা ১-১ গোলে অমীমাংসিত থাকে। বাংলাদেশের স্ট্রাইকার সাগরিকা একেবারে খেলার অন্তিম মূহুর্তে গোল করে খেলায় সমতা আনেন। টুর্নামেন্টে উভয় দলকে যৌথ ভাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়।
India and Bangladesh were indeed declared joint winners of the SAFF U-19 Women's Football Championship on February 8th, 2024.
The final match ended in a 1-1 draw, and even the penalty shootout went down to the wire, ending 11-11.
Initially, a controversial coin toss decided… pic.twitter.com/9nsO7Re5nS— Northeast Now (@NENowNews) February 9, 2024
৮ ফ্রেব্রুয়ারি ২০২৪ এ অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ ১৯ প্রতিযোগিতার ভারত বনাম বাংলাদেশ-এর ফাইনাল ম্যাচ ১-১ গোলে ড্র হয়। এমন কী পেনাল্টি শুট আউট উভয় দল সমান গোল করে, উভয় দল ১১ টি করে গোল করে, এরপর বিতর্কিত ভাবে টসের মাধ্যমে খেলার ফলাফল নির্ধারণ করা হয়, সেটাতে টস ভাগ্য ভারতের অনুকূলে গেলে দর্শকেরা মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
আলোচনা ও পরিস্থিতি বিবেচনায়, উভয় দল শিরোপা ভাগাভাগি করে নিতে রাজী হলে উভয় দলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়।
পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ খেলা সাগরিকা কেবল বাংলাদেশকে যৌথ চ্যাম্পিয়ন হতেই সাহায্য করেনি, টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে দীর্ঘ ছয় বছর পর নিজের বাড়ী ফেরার পথ প্রশস্থ করেছে।
মাঠ মাতাবে বলে পরিবারের বাঁধা এড়িয়ে খেলায় ছুটে যাওয়া
সাগরিকার পুরো নাম মোসাম্মৎ সাগরিকা। জন্ম বাংলাদেশের উত্তরে রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামে। এই গ্রামের এক দরিদ্র বাসিন্দা লিটন মিয়া ও তাঁর স্ত্রী আঞ্জু বেগম। তাদের নিজের কোন জমাজমি নাই। পরের জায়গায় এক চায়ের দোকান দিয়ে লিটনা মিয়া সংসার চালায়। লিটন মিয়া ও আনজু বেগমের দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটি বড়। সে ইট ভাটায় কাজ করে। গ্রামের অন্য সবার মত সাগরিকাও হয়তো অভাবের তাড়নায় একদিন ইট ভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজে যুক্ত হতো । কিন্তু তাঁর ভাগ্য পালটে দিয়েছে ফুটবল।
বাংলাদেশের মাঠপর্যায়ে বা গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলা মেয়েদের জন্য খুব কঠিন। অনেক প্রতিকুলতা পেরিয়ে তবে তারা মাঠে খেলতে পারে।
রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামে তাজুল ইসলাম নামের এক কলেজ শিক্ষক গ্রামে রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাটেড নামের এক ফুটবল ক্লাব গঠন করেছেন। এটি মূলত মেয়েদের এক ফুটবল ক্লাব। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েদের জন্য ফুটবল একাডেমি বা ক্লাব খোলা বা চালু করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু তিনি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়স ভিত্তিক মহিলা দলে রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড-এর বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় খেলছেন। নয় বছর বয়সে রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড-এ ফুটবল খেলতে শুরু করেন সাগরিকা।
কিন্তু বাঁধা আসে কিছু গ্রামবাসীর তরফ থেকে। কেবল সাগরিকার ক্ষেত্রে নয়, সকল মেয়েদের মেয়েদের ক্ষেত্রে। তবে তাজুল ইসলাম ও তার ফুটবল টিমেরা মেয়েরা এতে দমে যায়নি। তারা খেলা চালিয়ে যায়।
এবার সাগরিকার বাঁধা আসে পরিবারের তরফ থেকে। প্রতিবেশীরা এই পরিবারটিকে বলে ফুটবল খেলা ভালো নয়, ফুটবল খেললে মেয়ের বিয়ে হবে না। ফলে সাগরিকার পিতা মেয়ের ফুটবল খেলার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ফুটবল খেলার কারণে সাগরিকার বাবা দীর্ঘ দিন মেয়ের স্ঙ্গে কথা বলেনি। তবে এতেও সাগরিকা হাল ছেড়ে দেয়নি। সে তাঁর খালার কাছ থেকে সমর্থন লাভ করে, যে কিনা সাগরিকার বাবাকে মেয়ের খেলা চালিয়ে যাবার ব্যাপারে প্রভবিত করে। সে খেলা চালিয়ে যায়
ফুটবলে নৈপুণ্যের কারণে বাংলাদেশের সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ ক্রীড়াশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণের জন্য সাগরিকা নির্বাচিত হয়। কিন্তু সেখানকার নিয়মকানুন পছন্দ না হওয়ায় সাগরিকা আবার রাঙ্গাটুঙ্গি ফুটবল ক্লাবে ফিরে আসে।
বাংলাদেশে মহিলা ফুটবল লীগ চালু হবার পর অনেক মহিলা ফুটবলার লীগে খেলার জন্য উৎসুক হয়ে থাকতো। সাগরিকার সামনেও সে সু্যোগ আসে। ক্লাবের নাম এএফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সে দলে খেলতে গেলে যেতে হবে ঢাকা। বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল লীগ খেলতে সাগরিকা ঢাকায় গেল বটে কিন্তু তার গ্রামে ফিরে আসার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল।
ফুটবলের কারণে দীর্ঘ দিন ঘর ছাড়া
ওয়েব পত্রিকা সকাল সন্ধাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাগরিকা জানায়, ওমেন্স লীগে খেলতে যখন আমি ঢাকায় আসি, গ্রামের অনেকে আমার মাকে গিয়ে বলে, “ফুটবল খেলতে যায় তকখন গ্রামে রটে যায় সে কোন ছেলের সাথে পালিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। উক্ত পত্রিকার আরেকটি প্রশ্নের জবাবে সাগরিকা বলে, শুনলাম তোমার মেয়ে নাকি এক ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় পালিয়ে গেছে। তখন নারী লিগ চলছিল। ইউটিউবে খেলা দেখাতো। মা ওই ম্যাচের ভিডিও দেখিয়ে বলত, আমার মেয়ে ছেলে নিয়ে পালিয়েছে নাকি অন্য কিছু করছে টাচ ফোনে তোমরা দেখে নিও। এই চ্যানেলে খেলা দেখায়।
কিন্তু গ্রামের মানুষেরা সাগরিকার মায়ের কথা বিশ্বাস করেনি। সাগরিকা বুঝতে পেরেছিল বাড়িতে ফিরে এলে সে ঢাকায় আর ফিরে আসতে পারবে না। আর তার ফুটবল খেলা বন্ধ হয়ে যাবে। এরপর দীর্ঘ ছয় বছর সাগরিকা আর গ্রামের বাড়ীতে যেতে পারেনি।
A little bit shy at the post-match press conference after netting two fine goals in their SAFF U-19 Women’s C'ship opener against Nepal, Sagorika could not hide her brashness in the end while talking about her fight against family to become a footballer.https://t.co/Wq6Auc8T4K
— Dhaka Tribune Sports (@Sport_DT) February 2, 2024
নেপালের বিরুদ্ধে দুই গোল করার পর খেলা পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে খানিকটা লাজুক সাগরিকা ফুটবলার হওয়ার পথে আসা পরিবারের চাপের নিয়ে নিজের চাপা ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেনি।
সাফ অনুর্ধ-১৯ চ্যাম্পিয়নশীপ তার জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ২০২২-২৩ মহিলা ফুটবল লীগে তাঁর দুর্দান্ত খেলা নির্বাচকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে আর এখন সে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সদস্য।
গ্রামের অনেকেই সাগরিকার ফুটবল খেলা নিয়ে নিন্দা করতো এখন সেই গ্রামের সবাই এখন সাগরিকার জন্য গর্ব করে। দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার মতে গ্রামের অনেকে অনূর্ধ ১৮ সাফ গেমসে সাগররিকার খেলা দেখার জন্য তার বাবার দোকানে ভীড় করে যা কীনা টি -স্পোর্টস থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল। গ্রামের মানুষ যাতে সাগরিকার খেলা দেখতে পারে তার জন্য তার বাবা একটা টেলিভিশন সেট ভাড়া করে।
গ্রামবাসীদের অনেকে টেলিভিশনে সাগরিকার খেলা দেখেছে। ফাইনালে সাগরিকার খেলা যাতে সরাসরি দেখতে পারে সেজন্য সাগরিকার বাবামা রাজধানী ঢাকায় গিয়ে হাজির হয়। আর দেশের বাকী মানুষের মত এই প্রথম তারা তাদের মেয়ের খেলা সরাসরি দেখতে পেয়েছিল। ফাইনালে সাগরিকা তার বাবামাকে হতাশ করেনি।
ফাইনালে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশকে একেবারে খেলার অন্তিম মুহূর্তে গোল করে বাংলাদেশকে খেলায় ফেরায় সাগরিকা। এখন সাগরিকাকে নিয়ে তাঁর বাবামা অত্যন্ত গর্বিত। ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাগরিকার বাবা বলেন, “আমার মেয়ে প্রামাণ করেছে আমি ভুল ছিলাম সে ঠিক ছিল। তখন মনে হয়েছে যদি সে ফুটবল খেলতে থাকে তাহলে মেয়ে বড় হলে তার আর বিয়ে দিতে পারবো না। সে কারণে তখন তাকে খেলতে দিতে চাইনি। কিন্তু এখন বুঝি সে ঠিক ছিল আমি ভুল ছিলাম।”
বাংলাদেশ যৌথ চ্যাম্পিয়ন হলেও টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছে সাগরিকা। আর দীর্ঘ একটা সময় পরে সম্মান ও গৌরবের সাথে সাগরিকা নিজ ঘরে ফিরে এসেছে।
Mosammat Sagorika is the SAFF U-19 Women's Player of the tournament. 🇧🇩 pic.twitter.com/WXwlIfX5hx
— Plaantik (@Plaantik) February 18, 2024
সাফ অনূর্ধ ১৯ টুর্নামেন্টে প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট হয়েছে মোসাম্মৎ সাগরিকা
মে ২০২৪ এ সাগরিকা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের এক সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয় ।
সাগরিকার এই সাফল্য কেবল সাগরিকার নয় সারা বাংলাদেশ, এমন কী সারা বিশ্বের নারীদের জন্য প্রেরণা হয়ে উঠবে।